জুতার ব্যবসা বর্তমানে বাংলাদেশে একটি লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত। যেহেতু জুতা একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, তাই এর বাজার সবসময় ভালো থাকে। কমবেশি অনেকেরই ব্যবসা করার ইচ্ছা থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা করার আগে চাহিদা এবং বাজার সম্পর্কে জানা জরুরী হয়ে পড়ে।
তবে জুতার ব্যবসাটি হচ্ছে ব্যতিক্রম। কেননা জুতা হচ্ছে মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। তাই জুতার ব্যবসাটি হতে পারে আপনার জন্য সেরা একটি ব্যবসা। আপনি যদি একটি সফল জুতার ব্যবসা শুরু করতে চান, তবে নিচের বিস্তারিত গাইডটি আপনার জন্য সহায়ক হবে।
কেন জুতার ব্যবসা করবেন
বর্তমান সময়ে জুতার ব্যবসাটি অনেক লাভজনক একটি ব্যবসা হিসেবে গণ্য। এই ব্যবসায়ের ঝুঁকি অনেক কম। আপনি সঠিক পরিকল্পনা মাফিক এবং সঠিক পদ্ধতিতে যদি ব্যবসাটি শুরু করতে পারেন তাহলে অবশ্যই ব্যবসায় সফল হবেন।
১. বাজার চাহিদা বেশি: জুতার চাহিদা সবসময় রয়েছে। কারণ যেকোনো অবস্থাতে মানুষ জুতা পরিধান করে। সকল শ্রেণির মানুষ জুতা ব্যবহার করে, তাই বিক্রির সুযোগ বেশি।
২. কম বিনিয়োগে শুরু করা যায়: প্রথম অবস্থাতে আপনি ছোটখাটো একটি জুতার ব্যবসা শুরু করতে পারেন। অল্প পুঁজিতে ছোট পরিসরে শুরু করা সম্ভব।
৩. অনলাইন ও অফলাইন উভয়ভাবেই ব্যবসা করা যায়: বর্তমান সময় হচ্ছে আধুনিকতার যুগ। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আপনি চাইলে অনলাইনে ও আপনার ব্যবসার প্রচার করতে পারেন। ই-কমার্স এবং ফিজিক্যাল দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা যায়।
৪. বৈচিত্র্যময় পণ্য: শিশু, নারী, পুরুষ সবার জন্য বিভিন্ন ধরনের জুতা বিক্রির সুযোগ রয়েছে।
কিভাবে জুতার ব্যবসা শুরু করবেন?
একটি ব্যবসা শুরু করার আগে অবশ্যই সবকিছু পরিকল্পনা করা উচিত। ব্যবসাটি কোন জায়গায় শুরু করবেন, ব্যবসায়ের ধরন কেমন, ব্যবসাটি শুরু করতে কত পুঁজি প্রয়োজন ইত্যাদি। তাই নিম্নলিখিত প্রদক্ষেপগুলো অবশ্যই ফলো করবেন।
১. ব্যবসার ধরন নির্ধারণ করুন
আপনার ব্যবসা কোন ধরণের হবে তা আগে ঠিক করুন। উদাহরণস্বরূপ:
রিটেইল শপ (খুচরা বিক্রি)
হোলসেল ব্যবসা
ই-কমার্স (অনলাইনে বিক্রি)
ব্র্যান্ডেড শো-রুম
২. বিনিয়োগ পরিকল্পনা করুন
আপনার বাজেট নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৫০,০০০-৫,০০,০০০ টাকার মধ্যে বিনিয়োগ করে একটি মাঝারি মানের জুতার ব্যবসা শুরু করা যায়।
৩. ঠিকঠাক লোকেশন বেছে নিন
যদি আপনি একটি দোকান খোলার পরিকল্পনা করেন, তবে বাজার, শপিং মল বা জনবহুল এলাকায় স্থান নির্বাচন করুন।
৪. সরবরাহকারী বা উৎপাদকের সাথে সংযোগ করুন
সরাসরি কারখানা থেকে বা হোলসেল বাজার থেকে জুতা সংগ্রহ করলে খরচ কমে যায়। বাংলাদেশে গুলিস্তান, ইসলামপুর ও চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার বড় পাইকারি বাজার।
৫. লাইসেন্স ও অনুমোদন নিন
ছোট বড় সকল ব্যবসায় ট্রেড লাইসেন্স দরকার। তবে অনেকেই ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে এটি করে না। কিন্তু বড় বড় ব্যবসায় ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা যায় না। তাছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য ট্রেড লাইসেন্স গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার ব্যবসাকে বৈধ করতে নিচের লাইসেন্স সংগ্রহ করুন:
ট্রেড লাইসেন্স (সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা থেকে নিতে হবে)
ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন (যদি আপনার বিক্রির পরিমাণ বেশি হয়)
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পেমেন্ট গেটওয়ে সেটআপ (অনলাইন ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয়)
৬. জুতার গুণগত মান নিশ্চিত করুন
গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের এবং আরামদায়ক জুতা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ।
৭. দোকান সাজানো ও ডিজিটাল মার্কেটিং
আপনার দোকান বা অনলাইন স্টোর আকর্ষণীয়ভাবে সাজান। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, গুগল অ্যাডস ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রচারণা চালান।
৮. প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ করুন
স্থানীয় বাজার ও অনলাইন স্টোরের দাম যাচাই করে একটি সঠিক মূল্য নির্ধারণ করুন।
৯. ভালো গ্রাহকসেবা প্রদান করুন
গ্রাহকদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে সহজ রিটার্ন পলিসি ও দ্রুত ডেলিভারি সেবা দিন।
জুতার পাইকারি বাজার কোথায়
যে কোন ব্যবসার শুরুতেই পাইকারি বাজার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
১.বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি জুতার বাজার হলো গুলিস্তানের দক্ষিণ দিকের ফুলবাড়িয়া জুতার বাজার।
ঠিকানা: এটি মেয়র হানিফ ফ্লাইভারের উত্তর দিকে অবস্থিত। গুলিস্তান মেন রোড থেকে পূর্ব পশ্চিম দিকে দুইটি ভবন আছে যেখানে পাইকারি জুতা বিক্রি করা হয়ে থাকে। এখানে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান, চায়না এবং থাইল্যান্ডের জুতাও পাওয়া যায়।
২. ঢাকার চকবাজারেও রয়েছে জুতার পাইকারি বাজার।
ঠিকানা: চকবাজারের দক্ষিণ দিকে রয়েছে জুতার বাজার। তবে এখানে খুব ভালো মানের জুতা পাওয়া যাবে না। এখানে সাধারণত বাচ্চাদের খেলনা জুতাসহ বাচ্চাদের ও মেয়েদের জুতা বা ছেলেদের বার্মিস ধরনের জুতা পাওয়া যায়। যার দাম খুবই অল্প হয়ে থাকে।
৩. জুতার আরেকটি পাইকারি বাজার হচ্ছে ঢাকার যাত্রাবাড়ী।
ঠিকানা: যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ দিকের পোস্তগোলা ব্রিজের সামনে জুরাইন রেলগেট এর কাছাকাছি রয়েছে আলম সুপার মার্কেট। এখানে সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন স্লিপার, প্লাস্টিকের জুতা ও বার্মিজ জুতা পাওয়া যায়। এখান থেকে ব্যবসায়ের জন্য আপনি অল্প দামে জুতা কিনে নিতে পারবেন।
অনলাইনে জুতার ব্যবসা কিভাবে করবেন?
১. ওয়েবসাইট তৈরি করুন (Shopify, WooCommerce বা Wix ব্যবহার করতে পারেন)
২. ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে পেজ খুলুন
৩. ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করুন
৪. অনলাইন পেমেন্ট ও ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন রাখুন
৫. গ্রাহক রিভিউ সংগ্রহ করুন (বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে)
ব্যবসার সাফল্যের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
নতুন ডিজাইনের জুতা রাখুন
সিজন অনুযায়ী জুতার কালেকশন পরিবর্তন করুন
বিশ্বাসযোগ্য সরবরাহকারী নির্বাচন করুন
অফার ও ডিসকাউন্ট ক্যাম্পেইন চালান
স্টক ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো করুন
জুতার ব্যবসায় লাভ কেমন
জুতা সকলের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমাদের দেশে প্রতি বছর জুতার চাহিদা বাড়ছে। তাই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবসাটি শুরু করলে ব্যবসায় সহজে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। সাধারণত বড়দের জুতার চেয়ে শিশুদের জুতার চাহিদা বেশি থাকে। শিশুরা বাড়ে দ্রুত তাই তাদের জুতা অল্প দিনেই ছোট হয়ে যায়। আবার কিছু শিশুরা চঞ্চল থাকায় তাদের জুতা সহজেই নষ্ট হয়ে যায় প্রয়োজন হয় নতুন জুতা।
এদিকে বড়রা পুরনো একটি জুতো দিয়ে চালিয়ে নিতে পারলেও শিশুরা নতুন জুতা কয়দিন পর পর চায়। সবদিক বিবেচনায় রেখে বলা যায় যে শিশুদের বেশি জুতা প্রয়োজন হয়। আবার ফ্যাশন সচেতন নারীরা পোশাকের সাথে ম্যাচিং করে জুতা কিনতে পছন্দ করে। তাই তাদেরও জুতার চাহিদা রয়েছে। জুতা যেহেতু সকলেরই প্রয়োজন সেহেতু এই ব্যবসায় সফলতা সহজে আসে এবং বিপুল পরিমাণে লাভ রয়েছে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. জুতার ব্যবসা শুরু করতে কত টাকা লাগে?
> এটি নির্ভর করে ব্যবসার আকারের উপর। সাধারণত ৫০,০০০ টাকা থেকে শুরু করা সম্ভব।
২. পাইকারি জুতা কোথা থেকে কিনতে পারি?
> গুলিস্তান, ইসলামপুর, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার, ওয়ারী ইত্যাদি বড় পাইকারি বাজার।
৩. অনলাইনে জুতার ব্যবসা কিভাবে করবো?
> একটি ওয়েবসাইট তৈরি করুন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করুন এবং ক্যাশ অন ডেলিভারি/অনলাইন পেমেন্ট অপশন রাখুন।
৪. জুতার ব্যবসায় কত লাভ হয়?
> প্রোডাক্ট ও মার্কেটিং কৌশলের উপর নির্ভর করে ৩০-৫০% পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।
৫. নতুন ব্যবসায়ীদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
ছোট পরিসরে শুরু করুন, ভালো মানের পণ্য বিক্রি করুন এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এ মনোযোগ দিন।
শেষকথা, জুতার ব্যবসা লাভজনক ও দীর্ঘমেয়াদী একটি উদ্যোগ। সঠিক পরিকল্পনা, মানসম্পন্ন পণ্য ও ভালো গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করলে এই ব্যবসা থেকে বড় মুনাফা করা সম্ভব। আশা করি এই গাইড আপনাকে একটি সফল জুতার ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করবে। ধন্যবাদ।