রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত: এই আমলই বদলে দিতে পারে আপনার জীবন!

রমজান মাস ইসলামের অন্যতম পবিত্র ও বরকতময় মাস। এটি আত্মশুদ্ধি, ইবাদত-বন্দেগি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। এই মাসেই আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তাই রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। এই মাসে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা মুমিনের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধি এবং সওয়াব লাভের অন্যতম মাধ্যম। আজকের বিষয় হলো রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা।

রমজান ও কুরআনের সম্পর্ক

রমজান মাস এবং কুরআনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“রমজান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী নির্দেশনা হিসেবে।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, রমজান মাস কুরআনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে বিশেষভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং সাহাবিরাও এই মাসে কুরআন পাঠে বিশেষ মনোযোগ দিতেন।

রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত

জগত দুটি ভাগে বিভক্ত—স্রষ্টা এবং সৃষ্টি। তবে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে, যা হলো কুরআন শরীফ। এটি স্রষ্টাও নয়, সৃষ্টি‌ও নয়! কুরআন শরীফ আল্লাহ তায়ালার বাণী এবং মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এটি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়েতের উৎস। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “এই কুরআন নাজিল হয়েছে মানুষের জন্য পথনির্দেশনা এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ধারণের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান ৩:৩-৪)

কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বহুবার নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা আরাফে বলা হয়েছে: “যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নীরব থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়।” (৭:২০৪) এই নির্দেশনা স্পষ্টভাবে বোঝায় যে, কুরআন তেলাওয়াত রহমতের মাধ্যম। অন্যদিকে, সূরা আনফালে বলা হয়েছে: “যখন তারা কুরআন শ্রবণ করে, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে।” (৮:২) অর্থাৎ, কুরআন তেলাওয়াতের ফলে ঈমানের বৃদ্ধি ঘটে এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা বাড়ে।

কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে, যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন: “রমজান সেই মাস, যখন কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানবজাতির পথনির্দেশনা হিসেবে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ধারণের বিধানস্বরূপ।” (সূরা বাকারা ২:১৮৫) কুরআনের অবতরণের কারণে রমজান মাস হয়েছে বরকতময়।

হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, কুরআন তেলাওয়াতের জন্য প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে ১০টি নেকি প্রদান করা হয়। রমজান মাসে এই সওয়াব আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে: “রোজা আমার জন্য, এর প্রতিদান আমি নিজে দেব। আর প্রতিটি নেক কাজের জন্য দশগুণ থেকে অসংখ্যগুণ সওয়াব প্রদান করবো।” (বুখারী, হাদিস নং ১৭৭৩) তাই রমজান মাসে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সওয়াব অর্জন করার এটি একটি মহাসুযোগ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সামনে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী, হাদিস নং ১৭৮১) তাই এই মাসে কুরআন তেলাওয়াত করা শুধু সওয়াবের কারণ নয়, বরং এটি একটি সুন্নতও বটে।

ইসলামের ইতিহাসে বহু আলেম রমজান মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। যেমন:

  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.) দিনে এক খতম, রাতে এক খতম এবং পুরো রমজানে তারাবীহর নামাজে আরও এক খতম পড়তেন। (তারিখে বাগদাদ, ১৩তম খণ্ড)
  • ইমাম বুখারী (রহ.) প্রতি রাতে এক খতম কুরআন পড়তেন। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১১তম খণ্ড)
  • হযরত আবু কাতাদা (রহ.) প্রতি তিন দিনে এক খতম দিতেন এবং শেষ দশকে প্রতি রাতে এক খতম পড়তেন। (সিয়ারু আলামীন নুবালা, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

তবে শুধুমাত্র তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট নয়, বরং কুরআন বোঝার চেষ্টাও করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আমি এটিকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।” (সূরা ইউসুফ ১২:২) বোঝার চেষ্টা ছাড়া কুরআনের গভীর অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন: “আমি মানুষের জন্য কুরআনে সব দৃষ্টান্তই বিবৃত করেছি, যাতে তারা চিন্তা করতে পারে।” (সূরা যুমার ৩৯:২৭) তাই, কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি এর অর্থ অনুধাবনের চেষ্টাও করা উচিত। যারা কুরআন বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ কঠোরভাবে বলেন: “তারা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২৪)

সুতরাং, রমজান মাসে শুধু তেলাওয়াত করাই নয়, বরং অর্থসহ বোঝার চেষ্টা করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে সওয়াব যেমন অর্জিত হবে, তেমনি কুরআনের প্রকৃত শিক্ষা হৃদয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে কুরআন পড়ার, বোঝার এবং তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

কিভাবে রমজানে কুরআন তিলাওয়াত বাড়ানো যায়?

১. নিয়মিত সময় নির্ধারণ করুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কুরআন পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

২. তারাবির মাধ্যমে কুরআনের শ্রবণ: মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজে কুরআন শ্রবণ করুন।

৩. অর্থ ও তাফসির পড়ুন: কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়লে এর প্রভাব আরও গভীর হয়।

৪. পরিবারের সঙ্গে কুরআন পড়ুন: পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একত্রে কুরআন পাঠ করুন।

৫. কুরআনের হেফজ ও তাজবীদ শিখুন: রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতকে আরও সুন্দর করতে হেফজ ও তাজবীদ চর্চা করুন।

উপসংহার

রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস, আর কুরআন তিলাওয়াত সেই আত্মশুদ্ধির অন্যতম প্রধান উপায়। এই মাসে কুরআন পাঠ করলে আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত লাভ করা যায়। তাই আমাদের উচিত রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং কুরআনের শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই বরকতময় মাসে কুরআনের নূর দ্বারা আলোকিত জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে আশাকরি আপনার জানতে পেরেছেন।

রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনা করা হলো/FAQ

প্রশ্ন: কুরআন পড়া কি ফরজ?

উত্তর: কুরআন পড়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দৈনিক কুরআন পড়া ফরজ নয়, বরং শিক্ষা নেওয়া ও তেলাওয়াত করা সুন্নাত ও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। নামাজের মধ্যে কিছু আয়াত পড়া ফরজ। যারা কুরআন পড়তে জানে না, তাদের জন্য শিখা জরুরি (ওয়াজিব)।

প্রশ্ন: রমজানে কোরআন খতমের ফজিলত কী?

উত্তর: রমজানে কোরআন খতমের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম এবং গুনাহ মাফের সুযোগ। রাসুল (সা.) নিজে রমজানে জিব্রাইল (আ.) এর সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এই মাসে কোরআন খতম করলে সওয়াব বহু গুণ বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন: রমজানে পুরো কুরআন পড়ার সওয়াব?

উত্তর: রমজানে পুরো কুরআন পড়ার সওয়াব অসীম। এই মাসে কোরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি حرف (হরফ)-এর জন্য ৭০ গুণ বা তারও বেশি সওয়াব হয়। রাসুল (সা.) রমজানে জিব্রাইল (আ.) এর সঙ্গে কুরআন খতম করতেন, যা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। এটি গুনাহ মাফ, রহমত ও জান্নাতের মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যম।

প্রশ্ন: কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত কি?

উত্তর: কোরআন তেলাওয়াতের অসংখ্য ফজিলত ও সওয়াব রয়েছে। এটি হৃদয়কে প্রশান্তি দেয় এবং আল্লাহর রহমত লাভের মাধ্যম। নিয়মিত তেলাওয়াত করলে গুনাহ মাফ হয় ও জান্নাতের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

Sharing Is Caring:

Leave a Comment