রমজান মাসের বিশেষত্ব: সকল মাস থেকে রমজান মাস উত্তম কেন? জানুন গুরুত্বপূর্ণ কারণ!

ইসলামে বারোটি মাসের মধ্যে রমজান মাসকে সর্বোত্তম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এটি শুধু উপবাসের মাস নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, রহমত, মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস। এই মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের আলো। মুসলমানদের জন্য রমজান শুধু একটি ইবাদতের মাস নয়, বরং এটি তাদের আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো কেন রমজান মাস সকল মাসের মধ্যে সর্বোত্তম।

রমজান সেই মহান মাস, যখন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি বলেন: “শাহরু রমাদ্বা-নাল্লাযী উনযিলা ফি-হিল কুরআন”, যার অর্থ— “রমজান সেই মাস, যাতে আমি কুরআন নাযিল করেছি।”

এই আয়াত থেকেই স্পষ্ট যে রমজান অন্য সব মাসের তুলনায় অধিক মর্যাদাপূর্ণ, সম্মানিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু সমস্ত আসমানী কিতাবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আল-কুরআন এই মাসে নাযিল হয়েছে, তাই এটি অন্যান্য মাসের তুলনায় আরও বরকতময় ও মহিমান্বিত। চলুন তাহলে আলোচনা করি সকল মাস থেকে রমজান মাস উত্তম কেন!

রমজান নামকরণের অর্থ

বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুণীয়াতুত ত্বালেবীন’-এ উল্লেখ করেছেন যে ‘রমজ্বী’ শব্দের অর্থ বর্ষার বৃষ্টি। যেমন বৃষ্টি সমস্ত ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে ফেলে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করে, তেমনি রমজান মাস মানুষের পাপ মোচন করে আত্মাকে পবিত্র করে তোলে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই মাসের নাম ‘রমজান’ রাখা হয়েছে।

কেন রমজান মাস সর্বোত্তম?

পবিত্র রমজান মাস বহু কারণে অন্যান্য মাসগুলোর তুলনায় অনন্য মর্যাদার অধিকারী। এর বিশেষত্বগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রধান দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. কুরআন নাজিলের মাস

আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম পবিত্র কুরআন রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর এই মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়ার ফলে রমজান মাসের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

২. কুরআনে সরাসরি উল্লেখিত একমাত্র মাস

পবিত্র কুরআনে অন্য কোনো মাসের নাম উল্লেখ নেই, তবে রমজান মাসকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে এ মাসের মাহাত্ম্য অপরিসীম।

৩. আল্লাহর বিশেষ মাস

হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেন, “শা‘বান হলো আমার মাস, আর রমজান আল্লাহর মাস।” (মা’সাবাতা বিস সুন্নাহ)। এই মাসে রোজা রাখার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্রদান করবেন বলে ঘোষণা করেছেন।

৪. রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস

এই মাসের শুরুতেই আল্লাহর দয়া বর্ষিত হয়, মধ্য ভাগে গুনাহ মাফ করা হয় এবং শেষ দশকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “রমজান এমন এক মাস, যার প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফিরাত এবং শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময়।”

৫. শয়তানকে বন্দি রাখা হয়

রমজান মাসে শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যাতে তারা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। রাসুল (সা.) বলেন, “রমজানের প্রথম রাতে শয়তানদের বন্দি করা হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।” (বায়হাকি)

৬. ইবাদতের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি

রমজানের ইবাদতের সওয়াব অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। রাসুল (সা.) বলেন, “রমজানে নফল ইবাদত করলে তা ফরজের সমান সওয়াবের অধিকারী হয়, আর ফরজ আদায় করলে তা অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করে।” (বায়হাকি)

৭. দোয়া কবুলের মাস

এটি এমন একটি মাস, যখন আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই সময়ে দোয়ার প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন—

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রতিটি দিন ও রাতে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং প্রতিটি মুমিনের অন্তত একটি দোয়া কবুল করেন।”
—[মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৪৫০; মুসনাদে বাযযার, হাদিস : ৯৬২]

অতএব, যেকোনো সময় দোয়া কবুল হতে পারে। তাই বেশি বেশি দোয়া করা উচিত।

৮. সহানুভূতির মাস

রমজান এমন এক মাস, যা মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা জাগ্রত করে। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন—

“রমজান মাস হলো সহানুভূতির মাস।”
—[সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ১৮৮৭; শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৩৩৬]

রোজা রেখে ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে, অভাবী ও অসহায় ব্যক্তিরা কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাই এ মাসে দরিদ্র ও দুঃস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিত। বিপদের সময় কাউকে ছেড়ে না গিয়ে পাশে দাঁড়ানোই রোজার অন্যতম শিক্ষা।

৯. দানশীলতার মাস

রমজান শুধু সহানুভূতির মাসই নয়, এটি দানশীলতার মাসও। এ সময় দান ও সদকার সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়।

হাদিসে এসেছে, প্রিয় নবী (সা.) সারা বছরই দানশীল ছিলেন, কিন্তু রমজান মাসে তাঁর উদারতা ঝড়ো বাতাসের মতো প্রবল হয়ে উঠত। তিনি কারও চাহিদা শুনলে প্রচুর পরিমাণে দান করতেন।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন—

“নবী (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ দানশীল। তবে রমজানে, যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি কল্যাণময় বাতাসের চেয়েও বেশি দান করতেন।”
—[সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৬১৬]

এ শিক্ষা অনুসরণ করে আমাদেরও রমজানে দান-সদকা বাড়ানো উচিত।

১০. অসীম লাভের মাস

রমজান মাসে দানের মাধ্যমে কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হয় না, বরং এটি লাভের মাস। কারণ, এই সময় মুমিনের জন্য রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী (সা.) বলেছেন—

“রমজান মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়।”
—[সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ১৮৮৭; শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৩৩৬]

এ কারণে রমজানকে শুধু আত্মশুদ্ধির সময় হিসেবে নয়, বরং দান ও কল্যাণের মাধ্যমে অপরকে সহায়তা করার সুযোগ হিসেবেও গ্রহণ করা উচিত।

উপসংহার

রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত বরকত, রহমত ও মাগফিরাতের মাস। এটি এমন একটি সময় যখন মানুষ তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। এই মাসে রোজা রাখা, কুরআন তেলাওয়াত, তারাবিহ নামাজ পড়া এবং দান-সদকা করা ইত্যাদি আমল বেশি বেশি করার মাধ্যমে একজন মুমিন তার ঈমানকে শক্তিশালী করতে পারে।

রমজান শুধু একটি মাস নয়, বরং এটি একটি প্রশিক্ষণের সময়, যা মুসলমানদের সারাবছর তাকওয়া ও নৈতিকতা বজায় রাখার শিক্ষা দেয়। তাই, আমাদের উচিত এই মাসের গুরুত্ব বুঝে যথাযথভাবে ইবাদত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো। আশাকরি আপনারা বুঝতে পারছেন সকল মাস থেকে রমজান মাস উত্তম কেন!

Sharing Is Caring:

Leave a Comment