রমজান মাস মুসলমানদের জন্য পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এই মাসে ইবাদত, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রোজা রাখার সময় কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়, যাতে রোজা বিশুদ্ধ থাকে। অনেকেই জানতে চান, রমজানে আতর ব্যবহার করা যাবে কি না? বিশেষ করে, যখন আমরা নামাজ পড়তে যাই বা ইসলামী অনুষ্ঠানগুলোর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করতে চাই, তখন এই প্রশ্নটি সাধারণত সামনে আসে। এই প্রবন্ধে আমরা আতর ব্যবহারের ইসলামী দৃষ্টিকোণ, ফিকহি ব্যাখ্যা এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আতর ও ইসলামে এর ব্যবহার
রমজানে আতর ব্যবহার করা যাবে কি না এই বিষয়ে আলোচনা করার আগে ইসলামে আতর ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে জেনে নিই। ইসলামে আতর বা সুগন্ধির ব্যবহারকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আতর ব্যবহার করতেন এবং অন্যদেরও এটি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করতেন। হাদিসে এসেছে,
“তোমাদের জন্য পৃথিবীর দু’টি জিনিসকে ভালোবাসনীয় করা হয়েছে—নারী এবং সুগন্ধি।” (সহিহ বোখারি, মুসলিম)
সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত, বিশেষত নামাজের সময় এবং জুমার দিনে। তাই আতর ব্যবহারের বিষয়ে ইসলাম কোনো বাধা দেয় না, বরং এটি উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে রমজান মাসে রোজা অবস্থায় আতর ব্যবহার করা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে আসতে পারে।
রোজা রেখে আতর ব্যবহার করা যাবে কি না
রমজানে আতর ব্যবহার করা যাবে কি? সুগন্ধি বা আতর রাসুল (সা.)-এর অন্যতম পছন্দের বিষয় ছিল। তিনি নিজে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং কেউ উপহার দিলে তা গ্রহণ করতেন। কোনো সময়ই তিনি সুগন্ধি ফিরিয়ে দিতেন না।
আতর সবসময়ই ব্যবহার করা যায়, এমনকি রমজান মাসেও এটি ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে, এতে এমন কোনো উপাদান নেই যা ধোঁয়ার আকারে শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
রোজা ভাঙার মূল কারণ হলো, স্বাভাবিক পথ দিয়ে কিছু পেটে বা মস্তিষ্কে প্রবেশ করা। যেহেতু আতর বা পারফিউমের ঘ্রাণ শরীরে সরাসরি প্রবেশ করে না, তাই রোজা রেখে এগুলো ব্যবহার করলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
এটি মনে রাখা জরুরি যে, আতর ব্যবহার করা সুন্নত। তবে পারফিউমের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এতে অ্যালকোহল থাকতে পারে। বিশেষত, যদি এটি খেজুর বা আঙুরজাত অ্যালকোহল থেকে প্রস্তুত হয়, তবে তা অপবিত্র বলে গণ্য হবে। অন্য উৎস থেকে তৈরি হলে সেটি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আতর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা
রমজানে আতর ব্যবহারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যা মুসলমানদের জন্য উপকারী হতে পারে।
১. ইবাদতের সময় সুগন্ধি ব্যবহার
রমজানে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য ইবাদতের সময় আতর ব্যবহার করা সুন্নত। এটি মনোযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং পরিবেশকে পবিত্র করে তোলে।
২. মন্দ গন্ধ দূর করা
রোজা অবস্থায় মুখে অথবা শরীরে কোনো দুর্গন্ধ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ কিছু না খাওয়ার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। এই সময় আতর ব্যবহার করলে সতেজ অনুভূতি পাওয়া যায় এবং চারপাশের মানুষও বিরক্ত হয় না।
৩. আত্মবিশ্বাস ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি
সুগন্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে পরিষ্কার ও পরিপাটি মনে করেন। এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। রমজানে আতর ব্যবহারের ফলে মানসিকভাবে ভালো অনুভূত হয়, যা ইবাদতে মনোযোগী হতে সাহায্য করে।
আতর ব্যবহারের সময় সতর্কতা
যদিও আতর ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
- অ্যালকোহলমুক্ত আতর ব্যবহার করা ভালো: অনেক সুগন্ধিতে অ্যালকোহল থাকে, যা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিহারযোগ্য। তাই বিশুদ্ধ আতর ব্যবহার করা উত্তম।
- অতিরিক্ত আতর ব্যবহার করা ঠিক নয়: সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত, তবে অতিরিক্ত ব্যবহার করলে এটি অন্যদের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে।
- মহিলাদের জন্য সতর্কতা: নারীদের ক্ষেত্রে বাইরে যাওয়ার সময় আতর ব্যবহার সম্পর্কে হাদিসে কিছু সতর্কবার্তা আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে যায়, সে যেন ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হয়।” (আবু দাউদ)
উপসংহার
রমজানে আতর ব্যবহার করা ইসলামে অনুমোদিত এবং এটি রোজার জন্য কোনো ক্ষতির কারণ নয়। বরং এটি সুন্নত ও প্রশংসনীয় কাজ। তবে আতর ব্যবহারের সময় কিছু বিধিনিষেধ ও সতর্কতা মেনে চলা উচিত। অ্যালকোহলমুক্ত আতর ব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহার না করা এবং নারীদের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। রমজান মাসের পবিত্রতা বজায় রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা হলে এটি রোজাদারের জন্য উপকারী হতে পারে। তাই রোজার সময় আতর ব্যবহারে কোনো বাধা নেই, বরং এটি আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের জন্য সহায়ক হতে পারে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ FAQ
প্রশ্ন: রোজা অবস্থায় আতরের গন্ধ নেওয়া কি হারাম?
উত্তর: না, রোজা অবস্থায় আতরের গন্ধ নেওয়া হারাম নয়। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে এর গন্ধ গ্রহণ করা মাকরূহ হতে পারে। তাই সতর্ক থাকা উত্তম।
প্রশ্ন: রোজা রেখে কি কি করা যাবে না?
উত্তর: রোজা রেখে খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস করা নিষিদ্ধ। এছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, রক্ত নেওয়া বা সিগারেট খাওয়াও রোজার ক্ষতি করতে পারে। গীবত, মিথ্যা বলা ও ঝগড়া করা থেকেও বিরত থাকা উচিত।
প্রশ্ন: সুগন্ধি লাগালে কি রোজা ভঙ্গ হয়?
উত্তর: না, সুগন্ধি লাগালে রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে যদি এর ঘ্রাণ ইচ্ছাকৃতভাবে গভীরভাবে নিশ্বাস নিয়ে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা মাকরূহ হতে পারে। রোজা ভঙ্গের জন্য কিছু খাওয়া, পান করা বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি।