ভুল শুধরে নিন! রমজানের ভাঙ্গা রোজা রাখার নিয়ম ও করণীয়

রমজান মাস ইসলামের অন্যতম পবিত্র মাস, যেখানে মুসলমানদের জন্য রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। তবে কখনও কখনও অসুস্থতা, ভ্রমণ বা অনিবার্য কারণবশত কেউ যদি রোজা ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়, তাহলে সেই রোজার কাফফারা বা কাজা করার নিয়ম রয়েছে। ইসলামে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই বিধান সঠিকভাবে মানা জরুরি। এই নিবন্ধে আমরা রমজানের ভাঙ্গা রোজা রাখার নিয়ম ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ

রোজা ভঙ্গ করা ইসলামে অনুমোদিত নয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণে এটি বৈধ হতে পারে। রোজা ভঙ্গের মূল কারণগুলো নিম্নরূপ:

  1. অসুস্থতা: যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসক পরামর্শ দেন যে রোজা রাখা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তবে সে রোজা ভঙ্গ করতে পারে।
  2. ভ্রমণ: দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিলে রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি রয়েছে। তবে এটি শারীরিক কষ্টের উপর নির্ভরশীল।
  3. গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী: যদি গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী মা মনে করেন যে রোজা রাখা তাদের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তবে তারা রোজা ভঙ্গ করতে পারেন।
  4. জোরপূর্বক খাওয়া বা পান করা: যদি কেউ কোনো পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে খেয়ে ফেলে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
  5. নারীদের ঋতুস্রাব ও প্রসবকালীন রক্তস্রাব: এই অবস্থায় নারীদের রোজা রাখা নিষিদ্ধ এবং তাদের পরে এই রোজাগুলো কাজা করতে হবে।

রমজানের রোজার কাজা ও কাফফারার বিধান

রমজান মাস আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। রমজানের রোজা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। তবে কিছু পরিস্থিতিতে রোজা ভঙ্গ হলে বা রাখা সম্ভব না হলে, সেটির কাজা করা বাধ্যতামূলক। অনেকেই জানেন না, কোন অবস্থায় রোজা কাজা করতে হয় এবং কীভাবে তা আদায় করতে হবে। অনিবার্য কারণবশত রোজা ছুটে গেলে তা পরবর্তীতে আদায় না করলে ফরজ আমল পরিত্যাগের গুনাহ হবে।

কোন পরিস্থিতিতে রোজা কাজা করতে হয়?

রোজার কাজা করার অনুমতি রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু ওজরের কারণে। তবে এগুলো রোজা পুরোপুরি মাফ হওয়ার কারণ নয়। যথাসময়ে কাজা আদায় করাই ফরজ। সাধারণত এক রমজানের কাজা রোজা পরবর্তী রমজানের আগেই পালন করা উচিত।

যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হবে:

  • সফর অবস্থায় থাকলে
  • গুরুতর অসুস্থ হলে এবং রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলে
  • গর্ভবতী নারী বা দুধপান করানো মা যদি সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করেন
  • মারাত্মক ক্ষুধা বা তৃষ্ণার কারণে জীবন সংকটাপন্ন হলে
  • প্রবীণ ব্যক্তি শারীরিকভাবে অক্ষম হলে
  • সাপে কামড় দিলে
  • মাসিক (হায়েজ) বা প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত (নেফাস) হলে
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে
  • মুখে খাবার নিয়ে ভুলবশত গিলে ফেললে
  • নাকে বা কানে ওষুধ প্রবেশ করলে এবং তা পাকস্থলীতে পৌঁছালে

এসব ক্ষেত্রে কাফফারা আবশ্যক নয়, শুধু কাজা রোজা আদায় করলেই চলবে।

যেসব কারণে কাজার পাশাপাশি কাফফারাও দিতে হবে

কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শুধু কাজা নয়, বরং কাফফারাও ফরজ হয়। যেমন:

  • রোজা রেখে দিনের বেলা ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী মিলন করা (বুখারি: ৬৭০৯)
  • রোজা থাকা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করা (আল বাহরুর রায়েক: ২/২৭৬)
  • ধূমপান বা অন্য কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা (রদ্দুল মুহতার: ৩/৩৮৫)
  • সুবহে সাদিকের পরও খাবার খাওয়া, যদিও আজান শোনা না গেছে বা আলো পুরোপুরি দেখা যায়নি এমন অজুহাত দেখিয়ে

রোজার কাজা ও কাফফারা আদায়ের নিয়ম

যদি বিনা ওজরে কেউ রোজা ভঙ্গ করে, তবে কাজা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করা বাধ্যতামূলক।

কাজা রোজার বিধান:

প্রত্যেকটি ভঙ্গ করা রোজার জন্য সমপরিমাণ রোজা রাখতে হবে। অর্থাৎ, এক রোজার বদলে এক রোজাই যথেষ্ট।

কাফফারার বিধান:

রোজা ভঙ্গের কাফফারা আদায়ের জন্য তিনটি উপায় রয়েছে:

  1. টানা ৬০ দিন রোজা রাখা। যদি ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়, তবে নতুন করে শুরু করতে হবে।
  2. ৬০ জন গরিব বা মিসকিনকে দুই বেলা খাবার খাওয়ানো।
  3. কারও জন্য রোজা রাখা সম্ভব না হলে, অসহায় ও দুঃস্থদের প্রতিদিন দুই বেলা খাবার খাওয়াতে হবে।

রোজা কাজা রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

  • কাজা রোজার নিয়মিত নিয়ত করতে হবে এবং সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত সকল নিয়ম মেনে চলতে হবে।
  • কাফফারা রোজা একটানা রাখতে হবে, মাঝে কোনো বিরতি দিলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
  • কাজা রোজার ক্ষেত্রে দ্রুত আদায় করা ভালো, কিন্তু যদি কেউ দেরি করে তবে তাতে গুনাহ হয় না।
  • যারা অসুস্থতার কারণে দীর্ঘমেয়াদী রোজা রাখতে অক্ষম, তারা ফিদইয়া (দরিদ্রদের খাওয়ানোর মাধ্যমে) দিতে পারেন।

রোজা পুনরায় রাখার ফজিলত

রমজানের কাজা বা কাফফারা রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয় এবং পূর্বের ভুল সংশোধন করা সম্ভব হয়। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে:

“যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা সফরের কারণে রোজা রাখতে পারেনি, সে যেন অন্য কোনো সময়ে সে রোজাগুলো পূরণ করে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম ধর্ম সহজতর ব্যবস্থা রেখেছে এবং কোনোভাবেই মানুষকে কষ্টে ফেলতে চায় না।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং উত্তর/FAQ

প্রশ্ন: রোজা রাখার নিয়ত কিভাবে করতে হয়?

উত্তর: রোজার নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পবিত্র রমজান মাসের ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম, তুমি এটি কবুল করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

প্রশ্ন: রমজানের রোজা কিভাবে ভাঙব?

উত্তর: সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সাধারণত খেজুর ও দুধ দিয়ে ইফতার করা হয়, এরপর মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর পূর্ণাঙ্গ খাবার গ্রহণ করা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল হলো রমজান মাসের প্রতি রাতে এশার নামাজের পর অতিরিক্ত জামাতবদ্ধ নামাজে অংশগ্রহণ করা। এই বিশেষ নামাজকেই তারাবীহ বলা হয়।

প্রশ্ন: মাসিক হলে কি রোজা রাখা যায়?

উত্তর: একজন নারী মাসিক চলাকালীন নামাজ ও রোজা পালন থেকে বিরত থাকবে। পিরিয়ড শেষ হলে পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসল করা বাধ্যতামূলক, এরপর তিনি পুনরায় নামাজ ও রোজা পালন করতে পারবেন। যদি কোনো নারীর রোজা রাখার অবস্থায় সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে মাসিক শুরু হয়, তাহলে তার সেই দিনের রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে তা কাযা করতে হবে।

উপসংহার

রমজান মাসের রোজা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। তবে বিশেষ কারণে কেউ যদি রোজা ভঙ্গ করতে বাধ্য হন, তাহলে কাজা বা কাফফারা দিয়ে সেই রোজার প্রতিস্থাপন করা আবশ্যক। ইসলামের এই বিধান আমাদের জন্য মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। তাই সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে আমরা আমাদের কাজা ও কাফফারা রোজা পালন করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং আমাদের রোজা কবুল করুন, আমিন।

Sharing Is Caring:

Leave a Comment